বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরদিন বেশ দ্রুত গতিতে ঢাকায় নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যেভাবে অভিনন্দন জানিয়েছেন সেটি অনেকের কাছে বেশ ‘অপ্রত্যাশিত’ ছিল।
Sভারত, চীন ও রাশিয়া দ্রুত অভিনন্দন জানাবে এটা প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে পশ্চিমাদের পাশ কাটিয়ে জাপান যে অবস্থান নিয়েছে সেটি নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে।
এর বড় কারণ হচ্ছে – যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র জাপান। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়া নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছে।
বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, নির্বাচনের পর জাপান ছাড়া বাকিদের প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশিতই ছিলো।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে – এসব দেশের প্রতিক্রিয়া দেয়া পর্যন্ত জাপান অপেক্ষা করেনি। অথচ বছর দেড়েক আগে ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন জাপানি রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে সমালোচনা করেছিলেন।
মি. নাওকি বলেছিলেন, ২০১৮ সালে বাংলাদেশের একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগের রাতেই পুলিশ ব্যালট বাক্স ভর্তি করেছিলো বলে তিনি শুনেছেন। পৃথিবীর অন্য কোন দেশে এমন কথা শোনেননি বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তার সেই বক্তব্য সরকারের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি করেছিল।
প্রশ্ন হচ্ছে, এতো দ্রুত জাপানের অবস্থান বদলে গেল কেন? এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? বাংলাদেশ নিয়ে জাপানের দৃষ্টিভঙ্গিও কি ভারত, রাশিয়া ও চীনের মতো হয়েছে? এসব নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।
জাপানের প্রতিক্রিয়া কি অপ্রত্যাশিত?
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলে থাকেন, কূটনীতিতে সব দেশই নিজেদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে।
‘জাপান নিয়ে সবসময়ই একটু দ্বিধা থাকে। কারণ, কোনও কোনও ক্ষেত্রে পশ্চিমের সাথে তাদের প্রতিক্রিয়া মেলে না,’ বলছিলেন তৌহিদ হোসেন।
রোহিঙ্গা সংকটের উদাহরণ টেনে মি. হোসেন বলেন, ‘তখন পশ্চিম যতটুকু ‘লিপ সার্ভিস’ দিয়েছে জাপান তাও দেয় নি। তারা কিন্তু বিনিয়োগ এবং অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে সামরিক শাসকদের পক্ষেই ছিলো’।
B🃏
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির মনে করেন, জাপান নির্বাচন প্রক্রিয়াটাকে গ্রহণ করেছে ইতিবাচকভাবে।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, ‘এখানে একটা জিনিস মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশের সক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে কিন্তু খানিকটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার জায়গা এখানে হয়েছে। বড় বড় প্রজেক্টগুলো যদি দেখেন এক্সপ্রেসওয়ে করেছে চাইনিজরা, মেট্রোরেল করেছে জাপানিরা, পদ্মাসেতু করেছে চাইনিজরা’।
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির‘লক্ষ্য করবেন, আমাদের যে প্রয়োজন আমাদের যে চাহিদা সেই প্রয়োজনের যোগান দেয়ার মতো একটা কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিন্তু আছে। চীনারা যখন এই ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, জাপান কিন্তু তার জাতীয় স্বার্থের আলোকে সেখানে পিছিয়ে থাকতে চায়নি।’ যোগ করেন মি. কবির।
তার মতে, জাপানকে পশ্চিমা জগতের সহযোগী হিসেবে না দেখে চীন এবং জাপানকে পাশাপাশি দেখলে বুঝতে সুবিধা হবে কেন জাপান পশ্চিমা জগত থেকে বেরিয়ে এসে নিজস্ব অবস্থান নিলো।
‘প্রত্যেক দেশ তার নিজস্ব জাতীয় স্বার্থ এবং আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক অগ্রাধিকারের আলোকেই বাংলাদেশেকে তাদের পররাষ্ট্র নীতির অংশীদার হিসেবে চিন্তা করে।
চীন-জাপান তার ব্যতিক্রম নয়। দুই দেশেরই দৃষ্টিভঙ্গিটা মূলত অর্থনীতি কেন্দ্রিক।
কারণ তারা জানে এখানে বিনিয়োগের একটা বড় সুযোগ আছে। সেই সুযোগটা তারা কাজে লাগাতে চায়’।
‘সেক্ষেত্রে তারা এমন কোনও রাজনৈতিক অবস্থানে যেতে চায় না যে অবস্থানে গেলে তার অর্থনৈতিক স্বার্থটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে’। উল্লেখ করেন মি. কবির।
বিশ্লেষকদের বক্তব্যে স্পষ্ট, জাপান এশিয়া অঞ্চলের জন্য ‘নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি’ পোষণ করে।
ভারতের সংশ্লিষ্টতা আছে?
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামো উন্নয়নে, বিশেষতঃ দ্বিপাক্ষিক আর্থিক সাহায্যের ক্ষেত্রে জাপান বরাবরই সবচেয়ে বড় সহযোগী ছিলো।
তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ নামে কয়েকশ কোটি ডলারের চীনা উদ্যোগ এশিয়া ও আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অংশের মতো বাংলাদেশেও চীনের উপস্থিতিকে আরও দৃশ্যমান করে তোলে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে চীনের করা ওই উদ্যোগের বিকল্প দাঁড় করানোর একটা প্রচেষ্টা ভারত ও জাপানের মধ্যে লক্ষণীয়।
সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও আফ্রিকা জুড়ে অবকাঠামো প্রকল্প গড়ে তুলছে দেশ দু’টি।
বাংলাদেশে এ মূহুর্তে তিনশ’র বেশি জাপানি কোম্পানি কাজ করছে। দেশটির জন্য গড়ে তোলা হয়েছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলও।
সেই সঙ্গে যুক্ত হয় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রকল্প।
ভারত জাপান